কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরগুলোতে বাড়ছে অস্থিরতা। কোনোভাবেই থামছে না খুনের ঘটনা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা বলছেন, আধিপত্য বিস্তারের জেরে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। ক্যাম্পে বেশকিছু গ্রুপ মাদক কারবার, চাঁদাবাজি ও অপহরণসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এসবের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘটিত হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধ। এই অপরাধ আতঙ্কে ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারাও।
তেমনি এক ঘটনা ঘটেছে সোমবার ভোরে। ক্যাম্প-১৭ এর ১০৪ নম্বর ব্লকের ফাতেমা খাতুন। হঠাৎ একদল সন্ত্রাসী তার বাড়িতে ঢুকে পড়ে। চোখের সামনেই স্বামী ও দুই সন্তানকে গুলি করতে দেখেছেন এই নারী। সন্ত্রাসীদের নানা আকুতির পর তাদের পায়ে ধরে স্বামী সন্তানদের প্রাণ ভিক্ষা চান। তারপরও মন গলেনি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের। তার চোখের সামনেই তিনজনকে গুলি করা হয়।
সোমবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গের সামনে এসব কথা বলেন সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত আহমদ হোসেনের স্ত্রী ফাতেমা খাতুন।
এরআগে, সোমবার (২১ অক্টোবর) ভোর সাড়ে চারটার দিকে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন তার স্বামী আহমদ হোসেন (৬০), তার ছেলে সৈয়দুল আমিন (২৮) ও মেয়ে আসমা (১৩)।
এ নিয়ে ‘চলতি বছরের ২১ অক্টোবর পর্যন্ত সাড়ে ৯ মাসে আশ্রয়শিবিরগুলোতে ৬৪টি সংঘর্ষের ঘটনায় খুন হন ৭২ রোহিঙ্গা।
কান্নাজড়িত কন্ঠে স্বামী-সন্তান হারানো ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘১৫-২০ জন হবে। সবার হাতে ভারী অস্ত্র। স্বামীর সাথে সাথে ছেলেকে গুলি করে। পরে আমার ছোট বাচ্চা মেয়েটাকেও গুলি করে দেয়। কয়েক দফা আকুতি করেছি, পায়ে ধরেছি তারা আমার কোন কথা শুনেনি। আশে-পাশের কেউ আমার বিপদে এগিয়ে আসেনি বলেও জানান এই নারী।
নিহত আহমদ হোসেনের অপর ছেলে নুরুল আমিন বলেন, ‘কয়েকদিন আগেও শুনেছি বাবাকে তারা মেরে ফেলবে। ভোরে আমরা সবাই ঘুম ছিলাম। হঠাৎ ১৫-২০ জন এসে আমার বাবাকে ডাক দিল। পরে বাকিদেরও ডেকে তুললো। কোন কথা ছাড়ায় গুলি চালাচ্ছিল। আমার মা’ বার বার তাদের থামানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু তারা কোন কথা শুনেনি।
এবিষয়ে দায়িত্বরত ১৪ আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. ইকবাল বলেন,”ভোর সাড়ে চারটার দিকে ওয়ালাপালং পুলিশ ক্যাম্পের আওতাধীন বর্ধিত ক্যাম্প-২০ এর লাল পাহাড় সংলগ্ন এস-৪ ও বি-৭ ব্লক এলাকা দিয়ে ১৫-২০ জন অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারী প্রবেশ করে ঐ ব্লকে অস্থায়ীভাবে বসবাসরত আহমদ হোসেন ও তার পরিবারকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। বুকে ও গলায় গুলি করলে ঘটনাস্থলে দুজন নিহত হয়। পরে আহত অবস্থায় আহমদ হোসেনের মেয়ে আসমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রেরণ করা হলে পথিমধ্যে সে মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।”
মো. ইকবাল জানায়, “প্রাথমিকভাবে জানা যায়, নিহত রোহিঙ্গা সৈয়দুল আমিন আরসার সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে দীর্ঘদিন যাবৎ সম্পৃক্ত থাকার কারণে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা এইরূপ হত্যাকান্ড চালায়।
পরবর্তীতে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা লাল পাহাড়ের এস-৪, বি-৭ ব্লক দিয়ে পালিয়ে যায় বলে জানা যায়। এ ঘটনায় পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান তিনি।”
‘এআরএইচপিএস’র সভাপতি ডা: মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, ‘আধিপত্য বিস্তারের জেরে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। ক্যাম্পে বেশকিছু গ্রুপ মাদক কারবার, চাঁদাবাজি ও অপহরণসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এসবের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘটিত হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধ।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের খুনের ঘটনা বাড়ায় আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা। চলমান অস্থিরতায় অনুপ্রবেশও বাড়ছে বলে স্থানীয়দের। এসব ঘটনার পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে দাবি তাদের তাই বর্তমান সরকারের কাছে সমাধান চান তারা।
পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, ‘চলতি বছরের ২১ অক্টোবর পর্যন্ত সাড়ে ৯ মাসে আশ্রয়শিবিরগুলোতে ৬৪টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ৭২ জন রোহিঙ্গা খুন হয়। আরসার সঙ্গে আরএসও ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনের বাহিনীর মধ্যে অধিকাংশ ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে আরসার ২৫ ও আরএসওর ১১ সদস্য খুন হয়েছেন।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।”