বৃহস্পতিবার , ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

টেকনাফ

সবুজ পাহাড় ঘিরে ভয়ংকর অপহরণ চক্র

সাগর ও নাফনদের মাঝে সবুজ পাহাড়ঘেরা উপজেলা টেকনাফ। এই সীমান্ত উপজেলার পাহাড়ের বাঁকে-বাঁকে এখন বড় আতঙ্কের নাম ‘অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্য’। এমন আতঙ্কে টেকনাফের লাখো মানুষের জীবন হুমকিরমূখে পড়ছে প্রতিনিয়ত। এমনকি অপহরণের পর খোঁজ না পাওয়ার মানুষের লাশ মিলছে পাহাড়ে। দিন দিন এ ধরনের ঘটনা বেড়ে চললেও নেই স্থায়ী কোন সমাধান।

কারা এসব করছে, কেন করছে- প্রশ্নের জবাব মিলছে না কারও কাছে, প্রতিকারও পাচ্ছে না স্থানীয় জেলে, কৃষক থেকে শুরু করে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। এসব অপহরণের ঘটনার বেশিরভাগের রহস্যভেদ করতে পারছে না পুলিশও।

পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের তথ্য বলছে, ‘গেল এক বছরে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৫০ জন অপহরণের শিকার হন। এর মধ্যে ৮৮ জন স্থানীয় বাসিন্দা, ৫৬ জন রোহিঙ্গা নাগরিক। অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৭৮ জন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান বলে দাবি ভুক্তভোগীদের পরিবার ও জনপ্রতিনিধিদের।

জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা বলছেন, ‘মুক্তিপণ না পেয়ে তিন জনকে হত্যা করা হয়েছিল। পরে পাহাড় থেকে তাদের লাশ উদ্ধারের পর থেকে আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা চোখে পড়েনি। ফলে একের পর এক অপহরণের ঘটনা ঘটছে। দিনদুপুরে অস্ত্রসহ দলবল নিয়ে পাহাড়ের ভেতর থেকে এসে ধরে নিয়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চোখে পড়ছে না তাদের।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ‘রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা টেকনাফে বেশ আগেই পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যেসব অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছিল, সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে না নেওয়ায় এখন ধারাবাহিকভাবে ঘটছে এসব ঘটনা।

একের পর এক অপহরণের ঘটনায় উদ্বিগ্ন উল্লেখ করে কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘বিশেষ করে অপহরণ ও মুক্তিপণের আদায়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়দের জীবনযাত্রা ও নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে। ফলে অনেকে ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠানো নিরাপদ মনে করছেন না। এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করতে দ্রুত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। অন্যথায় অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্য আরও বাড়তে পারে।”

এদিকে, অপহরণ ও মুক্তিপণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কে দিন কাটছে স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের। অপহরণের পর অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরলেও আবারও একই ঘটনার শিকার হওয়ার আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সম্প্রতি অপরাধ বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যা ও সংঘাতের ঘটনায় ২৬৭টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ৪০টি হত্যা, ১৫টি হত্যাচেষ্টা, ৩০টি অস্ত্র, ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ও ১৪০টি মাদক মামলা। এ ছাড়া মানবপাচারসহ আরও কয়েকটি অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়েছে।

বিশেষ করে পাহাড়ি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় উপজেলার হ্নীলা ও বাহারছাড়া ইউনিয়নে অপহরণের ঘটনা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার জনপ্রতিনিধিরা। তাদের ভাষ্যমতে, গত বছরের তুলনায় এ বছর অপহরণের ঘটনা বেশি। যদিও পুলিশের খাতায় কম।

হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী মুঠোফোনে বলেন, ‘গত বছরের তুলনা এখন অপহরণের সংখ্যা বাড়ছে। এই ঘটনা এখন নিত্যদিনের। এতে পাহাড়ি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা জড়িত। গত পাঁচ মাসে আমার এলাকায় ২০টির বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। মুক্তিপণ না পাওয়ায় হত্যাও করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথ অভিযান না চালালে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের এক সদস্য বলেন, ‘অপহরণের ভয়ে আমার এলাকার লোকজন সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হন না। গত পাঁচ মাসে আমার এলাকায় অর্ধশতাধিক এমন ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন বেশিরভাগ।”

হত্যার ভয়ে অপহরণের শিকার লোকজন থানায় যেতে চান না উল্লেখ করে এই ইউপি সদস্য বলেন, ‘অপহরণের পর তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে উদ্ধার করা হয়েছে, এমন নজির নেই। পুলিশকে জানালে নির্যাতন করে হত্যার হুমকি দেয় অপহরণকারীরা। অনেক সময় পুলিশ পাহাড়ে অভিযানে যেতে অনীহা প্রকাশ করে।

জানা যায়, ‘ গেল ২ নভেম্বর টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কানজরপাড়ার করাচিপাড়া পাহাড়ি এলাকা থেকে দুই রোহিঙ্গাসহ ৯ কৃষককে অপহরণ করা হয়। লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে দুদিন পরে ফিরেন এসব অপহৃতরা।

গেল ১৭ অক্টোবর টেকনাফের বাহারছড়ার বসতঘর থেকে অপহরণের পর বেলাল উদ্দিন (৩২) নামের এক যুবককে তিন দিন পর উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় অপহৃত যুবকের চাচাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় উদ্ধার করা হয়েছে অস্ত্র ও গুলি।

পুলিশের দাবি, ‘জায়গাজমি হাতিয়ে নিতে ভাতিজাকে অপহরণের ষড়যন্ত্র করেছেন বেলালের চাচা আমির আহমদ। তিনি এই অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী। বেলালকে রোহিঙ্গা ডাকাত শফিকে দিয়ে তিনি অপহরণ করান। মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে বেলালের পরিবার জমি বিক্রি করলে তিনি অল্প দামে তা কিনে নেওয়ার ফন্দি আঁটেন। “

এছাড়া, গেল ১৬ অক্টোবর হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কম্বনিয়াপাড়ার পাহাড়সংলগ্ন কৃষিজমিতে কাজ করার সময় আরও দুইজনকে অপহরণের অভিযোগ উঠে।

টেকনাফের লেদা এলাকার সুলতান আহমেদের স্কুল পড়ুয়া সন্তানকে অপহরণ করা হয় সম্প্রতি। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হুমকি দিয়ে মোবাইল ফোনে অপহরণকারীরা বলেছে, ‘তুই ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলি। কিন্তু কোনও চালাকি করলে ছেলেকে গুলি করে দেবো। খোঁজাখুঁজি করতে হবে না। ছেলে ভালো আছে। জীবিত ফেরত চাইলে ৫০ লাখ টাকা দিবি। না হয় ছেলের লাশ পাবি পাহাড়ে। অপহৃত স্কুলছাত্র একদিন পর ফিরেছে। অপহরণকারীরা ৫০ লাখ টাকা দাবি করেছিল।

এলাকার সবাই একই আতঙ্কে আছেন উল্লেখ করে হ্নীলা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল হুদা বলেন, ‘সবার মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কে কখন অপহরণের শিকার হয়, তা নিয়ে ভয় সবার। অনেকে বিদ্যালয়ে সন্তানদের পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। এসব ঘটনার পেছনে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তাদের দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে।”

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘প্রযুক্তির সহায়তায় অপহৃতদের অবস্থান জানার চেষ্টা করে পুলিশ। অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে উদ্ধারও করা হয়েছে। আটক করা হয় কয়েকজন অপহরণকারীকে।

ওসি বলেন, ‘আগের তুলনায় এখন অপহৃত পরিবারের সদস্যরা বেশি থানায় আসছেন। আমরাও অপহরণকারীদের ধরতে তৎপরতা বাড়িয়েছি। তবে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে চলাচলের সুযোগ বন্ধ না হলে, অপহরণের ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না। সেটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নকে নিশ্চিত করতে হবে।”

এবিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার র‍্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্ণেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘দুর্গম পাহাড়ে র‍্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়ছে। বেশ কয়েকটি অভিযানে অনেকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা আরও অভিযান চালানো হতে পারে। ”


সম্পর্কিত খবর

Flight Centre

Demo Description

This will close in 20 seconds