শুক্রবার , ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বিশেষ প্রতিবেদন

রামু ট্রাজেডির ১২ বছর

১২ বছর ধরে সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে ১৮ মামলা

কক্সবাজারের রামু ট্র্যাজেডির ১২ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধপল্লির ২৬টি ঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা করে দুর্বৃত্তরা। পরদিন পুড়িয়ে দেওয়া হয় উখিয়া-টেকনাফের আরো ৭টি বৌদ্ধ বিহার। 

শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) রামু সীমা বিহার বৌদ্ধ মন্দির ঘুরে দেখা যায়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক। নিরাপত্তা জোরদার রয়েছে। শান্ত রয়েছে চারপাশের পরিবেশ। পূজা-অর্চনায় মগ্ন ধর্মভীরু লোকজন। বৌদ্ধরা বললেন, তারা  সব ধর্মের মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকেন। তবে হামলার আশঙ্কা পুরোপুরি কাটেনি। 

রামুর বাসিন্দা সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিককর্মী সুনীল বড়ুয়া বলেন, এ ঘটনায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি মামলার বাদী হয়নি। মামলা করেছেও পুলিশ, তদন্ত করেছেও পুলিশ। এতে তারা ইচ্ছেমতো আসামি করেছে এবং মামলার অভিযোগ থেকে বাদও দিয়েছে। ফলে মামলার তদন্তে ত্রুটি থেকে গেছে।

সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘রামু সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এক যুগ কেটে গেলেও এখন পর্যন্ত অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয়দের দায়ের করা ১৮টি ফৌজদারি মামলার মধ্যে কোন কোন মামলায় পিবিআই অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলেও মামলার বিচার এখনো পর্যন্ত শুরু হয়নি। বিগত বিশ বছরের ঘটনাগুলোকে বিবেচনায় নিলেও দেখা যাবে কোন একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। ফৌজদারি মামলার বিচার করে রাষ্ট্র, তাই এক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায় যদি কাউকে দিতে হয় তাহলে সেটি রাষ্ট্রের উপরই পড়বে। বিগত সরকারগুলোর এধরণের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার করার ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ছিল না বললেই চলে। এর ফলে ভুক্তভোগীদের মধ্যে দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর কোনো প্রকার আস্থা তৈরি হয়নি। অন্য যেকোনো অপরাধের মত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অপরাধের বিচার করা গেলে সকলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বাড়তো।”

তিনি আরও বলেন, ‘অবিশ্বাস নিয়ে পাশাপাশি চলা যায় না। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈষম্য বিলোপের আওয়াজ উঠেছে চারিদিকে। তাতে আইনি এবং বিচারিক বৈষম্যও দূর হবে এটাই সাধারণের প্রত্যাশা। কিন্তু মৌলবাদের যে আস্ফালন দেখা যাচ্ছে তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব দরকার যেখানে সকলে মিলে দেশটাকে গড়ে তোলার প্রত্যয় থাকবে।”

রামুর কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ শীলোপ্রিয় মহাথেরো বলেন, ‘হামলাকারীরা দল-মত নির্বিশেষে ধর্মীয় সম্প্রীতিতে আঘাত হেনেছিল। তারা যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে তা ১২ বছরে আমরা সবাই মিলে অনেকটা কাটিয়ে উঠেছি। তবে দুঃখের বিষয় হলো হামলার ১২ বছরে ওই ঘটনার হামলাকারীদের পরিচয় এখনো অজানা। সবসময় হামলার আশঙ্কা রয়েছে। হামলা থেকে আমরা রক্ষা পেতে চাই। সরকারের সহযোগিতা চাই।”

দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়ে যাওয়া বৌদ্ধ স্থাপনা।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী; পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ছৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ‘বৌদ্ধ মন্দিরে মামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা গুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ ঘটনায় ১৮টি মামলার মধ্যে প্রায় ৯০০ জন আসামি ও ১৬০ জনের মতো সাক্ষী আছেন। মামলাগুলো বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। আমরা চেষ্টা করছি তথ্য প্রমাণ আর সাক্ষীর মাধ্যমে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে। কিন্তু সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে বিচার প্রক্রিয়া কিছুটা থমকে আছে। সাক্ষীদের নামে সমন জারি করা হয়েছে অনেকবার। কয়েকটি মামলায় সাক্ষী চলমান থাকলেও সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন তারা। তিনটির মতো মামলা পুন:তদন্তের জন্য পিবিআই এর কাছে পাঠানো হয়েছে। আলোচিত এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আমাদের আন্তরিকতার কমতি নেই। মামলার সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে না চাওয়ায় মামলার নিষ্পত্তিতে দেরি হচ্ছে। সাক্ষীরা আদালতে আসলে প্রয়োজনে পুলিশী নিরাপত্তা দেওয়া হবে।”

হামলার ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়। তন্মধ্যে ১টি মামলা বাদী কর্তৃক আপোসে মীমাংসা হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাবেক রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম। মামলাগুলোতে এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জনসহ ১৫ হাজার ১৮২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। পরে আপোসের ভিত্তিতে একটি মামলা প্রত্যাহার হলেও বাকি ১৮ মামলায় ৯৯৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় তদন্তকারী সংস্থা।”

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের হাইটুপি গ্রামের উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুক থেকে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে বৌদ্ধ বিহার ও পল্লিতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওই দিনের হামলায় কয়েকশ বছরের প্রাচীন ১২টি বৌদ্ধবিহার ও ২৬টি বসতঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও বৌদ্ধবিহার ও ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়িগুলোতে ব্যাপকভাবে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।”

এদিকে ১২ বছরেও উত্তম কোথায় আছেন তা পরিবার বা এলাকাবাসী কেউ জানেন না। উত্তমের বাবা সুদত্ত বড়ুয়া ও মা মাধু বড়ুয়া বলেন, ঘটনার পর থেকে উত্তম কোথায় আছেন তা তারা জানেন না। অপেক্ষায় আছি ছেলে একদিন ফিরে আসবে। উত্তমের স্ত্রী রিতা বড়ুয়া ও ছেলে আদিত্য বড়ুয়াও তার ফেরার অপেক্ষায় আছে। 


সম্পর্কিত খবর

Flight Centre

Demo Description

This will close in 20 seconds