কক্সবাজার পৌরসভার সাগর তীরবর্তী এলাকা সমিতিপাড়া। যেখানে রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ শুটকি পল্লী। এই শিশুরা শিক্ষার দিক পিছিয়ে থাকে সব সময়। তাই শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ে হাজারো শিশু। তাই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ছয় তরুণ কক্সবাজার নাজিরারটেক শুঁটকিপল্লিতে গড়ে তুলেছেন ‘ম্যাজিক বোর্ড স্কুল’। শিক্ষাকে সমাজের সর্বস্তরে উন্মুক্ত করতে শুরু করতে এই কার্যক্রম বলে জানিয়েছে তরুণরা।
জানা গেছে-সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে শিক্ষার মশাল জ্বালাতে নাজিরারটেক মোস্তাকপাড়ায় একটি কক্ষ থেকে শুরু হয় পথচলা। হাটবাজার কিংবা শুঁটকিপল্লিতে প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকের চেয়ে শিশুশ্রমিক বেশি। এই বয়সে যাদের কাঁধে বইয়ের ব্যাগ থাকার কথা, তাদের কাঁধে মাছের ঝুড়ি, হাতে ইজিবাইকের স্টিয়ারিং।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাঠদান ও শিক্ষার সরঞ্জাম সরবরাহসহ সৃজনশীলতা এবং শেখার প্রতি আগ্রহও জাগিয়ে তুলছেন জিমরানসহ তানজিলা, ফাহিম তাজনোহাদ, আসিফ আহমদ উদয়, মিজানুর রহমান ও কাউসার আহমদ কায়েসরা। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনামূল্যে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান, একাডেমিক বিষয়ের পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতা এবং কম্পিউটারের মৌলিক দক্ষতাও নিজেদের পাঠদানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এসব তরুণ।
সংগঠনটির অন্যতম উদ্যোক্তা জিমরান সাইয়াক বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকে বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকায় নাজিরারটেক শুঁটকিপল্লিতে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছি। ছিলাম শিক্ষা, শিশুশ্রম বন্ধ, বাল্যবিয়ে বন্ধে বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গেও। সেই জায়গা থেকেই চিন্তায় আসে এখানে একটা স্কুল গড়ে তোলার।’ সেই পরিকল্পনা থেকেই কলেজ জীবনের সূচনায় জিমরান বন্ধুদের নিয়ে শুরু করেন এ উদ্যোগ। শুঁটকিপল্লির সুবিধাবঞ্চিত ৩০ শিশু নিয়ে যাত্রা শুরু তাদের ‘ম্যাজিক বোর্ড স্কুলের’।
নিজেদের কার্যক্রম সম্পর্কে জিমরান সাইয়াক বলেন, ‘ম্যাজিক বোর্ড স্কুল সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য উন্মুক্ত। এখানে দিতে হয় না কোনো খরচ। আমরা শিশুদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করি। এ ছাড়া ম্যাজিক বোর্ড স্কুল স্থানীয় শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। আগামীতে আমাদের এই কার্যক্রম সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই!’
‘ম্যাজিক বোর্ড স্কুল’র উদ্যোক্তা আসিফ আহমদ উদয়, ‘বলেন- কক্সবাজার জেলায় শিশুশ্রম নিরসনে কারো মাথা-ব্যথা নেই। হাটবাজার কিংবা শুঁটকি পল্লীতে প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকের চেয়ে শিশু শ্রমিক বেশি। এই বয়সে যাদের কাঁধে বইয়ের ব্যাগ থাকার কথা তাদের কাঁধে মাছের ঝুড়ি, হাতে ইজিবাইকের (টমটম) স্টিয়ারিং আর পায়ে রিকশার প্যাডেল। শিশুশ্রম নিরসনে কারো নজর নেই। নেই কোনো সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। তবে দুয়েকটি বেসরকারি এনজিও সংস্থা আপাতত শিশু নিরসন নিয়ে কাজ করছে কক্সবাজারে।শিশুশ্রমের বিষয়ে সরকারের পক্ষে কাজ করে জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদ। কিন্তু কক্সবাজার জেলায় এই কমিটির কোনো সমন্বয় নেই।”
তিনি আরও বলছেন- শহরের নাজিরারটেক শুঁটকি পল্লীতে, শুঁটকি মাছের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে আসা-যাওয়া শিশুরা। পেটের দায়ে এসব কাজ করে। স্কুলের কথা বললে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, বাড়িতে খাবার কি আপনি দিবেন? এমন কঠিন প্রশ্ন করে বসে ছোট ছোট শিশুরা।শিশুদের পারিশ্রমিক কম দিতে হয় বলে ব্যবসায়ীরা বা আড়ৎদাররা শিশুদের দিয়ে কাজ করায়। দিনশেষে কাজ বেশি আদায় করে কম পারিশ্রমিক দেওয়ার অভিযোগ অহরহ! শিশু শ্রম ঠেকাতে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
স্কুলটির উদ্যোক্তা তানজিলা ওশান ওহী বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকে বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকায় নাজিরারটেক শুটকি পল্লীতে বিভিন্ন ধরনের কাজ হতো। শিক্ষা, শিশুশ্রম বন্ধ, বাল্যবিবাহ বন্ধে বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলাম! সেই জায়গা থেকেই চিন্তায় এসেছিল এই এলাকায় একটা স্কুল করা যায় কিনা। যারা শিশুশ্রম করে তাদেরকে যাতে আমরা পড়াশোনায় ফিরিয়ে এনে আনতে পারি। প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল, যেসব শিশুরা শিশুশ্রমের সাথে জড়িত তাদেরকে শিক্ষার আলোতে নিয়ে আসা। মৌলিক অধিকার শিক্ষাকে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের হাতে তুলে দিয়ে তাদেরকে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা।
প্রসঙ্গত যে- শুঁটকি পল্লীর সুবিধা বঞ্চিত ৩০ জন শিশুদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে ম্যাজিক বোর্ড স্কুল ২০২৩ সালে। কক্সবাজারের নাজিরারটেক শুটকি পল্লীতে, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার পথে ফিরিয়ে আনতে শুরু করা হয়েছিল ম্যাজিক বোর্ড স্কুলের শিক্ষার কর্মযজ্ঞ। লক্ষ্য, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাঠদান ও শিক্ষার সরঞ্জাম সরবরাহ করা। তারা এমন একটি স্কুলের প্রয়োজন দেখেছে যা শুধুমাত্র একাডেমিক নির্দেশনাই দেবে না বরং সৃজনশীলতা এবং শেখার প্রতি ভালোবাসাকেও উৎসাহিত করবে। তবে বর্তমানে সেই উদ্যোগটি কেবল সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং ডালপালা মেলেছে প্রচুর। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনামূল্যে, মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান, উৎসাহিত, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করা ।
ম্যাজিক বোর্ড স্কুল একটি বিস্তৃত পাঠ্যক্রম পরিচালনা করছে যেটিতে গণিত, বিজ্ঞান এবং ভাষা শিল্পের মতো প্রথাগত একাডেমিক বিষয়ের পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতা এবং কম্পিউটারের মৌলিক দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীদের শিল্প ও সঙ্গীতের মতো সৃজনশীল ক্রিয়াকলাপে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগও দেয়।
ম্যাজিক বোর্ড স্কুলটি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য উন্মুক্ত, স্কুলে উপস্থিত হওয়ার জন্য কোন খরচ নেই, এবং সমস্ত প্রয়োজনীয় সরবরাহ এবং উপকরণ সরবরাহ করা হয়। ম্যাজিক বোর্ড স্কুলে পড়া শিশুদের জীবনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। অনেক শিক্ষার্থী যাদের আগে সীমিত শিক্ষার সুযোগ ছিল তারা এখন একাডেমিকভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে উন্নতি করছে। স্কুলটি শিক্ষার্থীদের তাদের সম্প্রদায়ের পরিবর্তনের এজেন্ট হওয়ার ক্ষমতা দেয়, কারণ তারা তাদের শেখা দক্ষতা এবং জ্ঞান গ্রহণ করে এবং বাস্তব-বিশ্বের পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করে।”