
কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কের পর্যটন স্পট হিমছড়ি সংলগ্ন ‘মারমেইড বিচ রিসোর্টে’র বিরুদ্ধে সমুদ্র সৈকত দখলের অভিযোগ নতুন নয়। এবার ডিজে ও মদের পার্টির জন্য বিশেষ জোন তৈরি করেছে ঝাউবিথীর বাগানে। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘ফুল মুন বিচ পার্টি’। যেখানে কাটা পড়েছে শত শত ঝাউগাছ। সমুদ্র সৈকত রক্ষায় রোপণ করা ঝাউবিথী উপড়ে ফেলা হয়েছে। যারফলে পরিবেশের পাশাপাশি ক্ষতিরমূখে পড়ছে দেশের একমাত্র ‘মেরিনড্রাইভ সড়ক’।
এছাড়াও, অভিযোগ উঠেছে স্বৈরাচার আওয়ামীলীগ সরকারের সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইসিটি মন্ত্রী পলকসহ একাধিক মন্ত্রী-প্রভাবশালী নেতার বলয় দেখিয়ে একের পর এক সমুদ্রের বালিয়াড়ি দখল করেছেন রিসোর্টটির মালিক আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগ। নিজেকে শেখ পরিবারের একজন দাবী করা সোহাগ একের পর এক দখল চালিয়ে গেলেও গেল ১৫ বছর প্রশাসনের কেউ সেদিকে নজর দেননি অদৃশ্য কারণে।”

তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি প্রশাসনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বহমান খালের উপর অবৈধ একটি সেতু নির্মান করেছে। যে সেতুর উপর দিয়ে যেতে হবে সেই বিশেষ ডিজে ও মদের জোনে। পর্যটনের দোহায় দিয়ে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ড চললেও সবাই অদৃশ্য কারণে চুপ।
হিমছড়ির ট্রলার মাঝি রফিকুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এ খাল দিয়েই স্থানীয়রা ছোট ইঞ্জিন চালিত ট্রলার নিয়ে সাগরে মাছ শিকারে বের হতো। খালের উপর সেতু নির্মাণ করায় সেতুর নিচ দিয়ে ট্রলার চালানো যাচ্ছেনা। ফলে অনেকে তাদের মাছ ধরার ট্রলার বিক্রি করে দিয়েছেন।

শুক্রবার (৪ সেপ্টম্বর) বিকেল থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত সরেজমিনে ‘মারমেইড বিচ রিসোর্টে দেখা যায়, ‘ পর্যটক বা স্থানীয়রা নির্মিত সেতু দিয়ে সেখানে প্রবেশ করতে চাইলে বাধা দেয়া হয়। পরবর্তীতে ‘বিশেষ টোকেন’ হাতে দেয়ার পর প্রবেশ করতে পারে পর্যটকরা। স্থানীয়দের ফিরিয়ে দেয়া হয়। কৌশলে একজনকে ম্যানেজ করে সেই সেতু দিয়ে বিশেষ জোনে যায় প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে দেখা মিলে শত শত ঝাউবিথী কেটে তৈরি করা হয়েছে নাচ-গানের মঞ্চ, কফি সপ’, বা ‘মদের বার সাদৃশ্য বিশেষ জোন। এটি মূলত সমুদ্রে গজিয়ে উঠা চর। সেখানে ঝাউবিথী রোপণ করে বন বিভাগ। যা কেটে অবকাঠামো তৈরি করেছে মারমেইড বিচ রিসোর্ট।”
প্রবেশের পথে বাধা দেয়া মারমেইড বিচ রিসোর্টের কর্মী ‘রেব হেম’ জানান, ‘ বিশেষ অনুমতি ছাড়া এই সেতুতে প্রবেশ নিষেধ। এটা কর্তৃপক্ষের বিশেষ ‘টোকেন ছাড়া এখানে কাউকে প্রবেশ করতে না দিতে বলা হয়েছে।’
পরে রেস্টুরেন্টের কর্মী সালাম আসেন। তখন তিনি দাবি করেন, নিরাপত্তা ঝুকি থাকায় রাতে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। পরে তাকে ম্যানেজ করে সেখানে প্রবেশের অনুমতি মিলে প্রতিবেদকের।

ভেতরে প্রবেশের পর দেখা মিলে আরেক কর্মী ওসমান গণির। তার কাছে ‘প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার’ কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ এখানে শুধুমাত্র রুমে যারা আছেন তারা আসতে পারবেন। আর প্রতি মাসে একটি বিশেষ ‘ডিজে পার্টি’ হয়। সাড়ে তিন হাজার টাকায় জনপ্রতি ফি’ নেয়া হয়। শুধু তারায় এখানে ‘এলাও’।
‘বিশেষ ডিজে’ পার্টিতে ‘কি কি থাকে বা খাবার কি থাকে’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ তেমন কিছু না, শুধু বিদেশী বিয়ার বা মদ থাকে আর নাচ-গান।”
তবে কেউই ঝাউবিথী কেটে কেনো এমন স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি। তাদের কাছে কয়েক দফা জানতে চাওয়া হলেও তারা কোন উত্তর দেননি।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে খুনিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের একজন ইউপি সদস্য প্রতিবেদককে বলেন, ‘মূলত মারমেইড বিচ রিসোর্টটি পড়েছে রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নে। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উন্মুক্ত বহমান খালের উপর মারমেইড বিচ কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি সেতুটি নির্মাণ করে। মারমেইড বিচ কর্তৃপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ার কারণে কোন কিছুই তোয়াক্কা করছে না। তারা সম্প্রতি রাতের আঁধারে সেতুটি নির্মাণ করে অবৈধভাবে। কারণ চলমান খালের উপর সেতু নির্মাণ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। বিষয়টি স্থানীয় জনগণের দৃষ্টিগোচর হয়। এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে অভিযোগ আকারে জানালে উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ এসে বিষয়টি দেখে চলে যায়। শুনেছি প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই মারমেইড বিচ কর্তৃপক্ষ সেতুটি খালের উপর দৃশ্যমান রেখেছে।
ওই ইউপি সদস্য আরও জানান, ‘মারমেইড বিচ রিসোর্টের মালিক সোহাগ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে নামমাত্র মুল্যে হুমকি-ধামকি দিয়ে কিছু কাগজি জমি ক্রয় করেন। তারপর থেকে সেই জমির পাশে গজিয়ে উঠা সমুদ্র সৈকতের বিশাল বালিয়াড়ি এলাকা অবৈধ দখলে রেখেছে।মারমেইড বিচ রিসোর্টের বিশাল এলাকার অধিকাংশই খাসজমি ও সৈকতের বেলাভূমি। অল্প সংখ্যক জমি কিনে পাশের খাস জমি ও সৈকতের বালিয়াড়ির জমির মধ্যেই গড়ে উঠেছে মারমেইড বিচ রিসোর্ট। শেখ পরিবার ও তাদের মন্ত্রীদের সাথে সম্পর্ক রেখে এবং কমিশন দিয়ে সমুদ্র সৈকতের বিশাল এলাকা দখলে রেখে গলাকাটা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে মারমেইড বিচ কর্তৃপক্ষ।

তথ্যমতে, ‘বালিয়াড়ি, পাথরময় জোয়ার-ভাটা অঞ্চল, উপকুলীয় জলাভূমী ও কোরালসহ সামূদ্রিক দ্বীপ রক্ষায় কক্সবাজারের সৈকত এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল এ সংক্রান্ত গেজেটও প্রকাশ করে সরকার। এ নির্দেশনা মতে, ১২০ কিলোমিটার সমুদ্রসৈকত, সৈকতের ঝাউ গাছসমৃদ্ধ ৩০০ মিটারে যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ ও উন্নয়ন নিষিদ্ধ ও ৫০০ মিটার সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি মারমেইড বিচ রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ সেই আদেশ অমান্য করে সবকিছুই তৈরি করেছেন।
এছাড়া, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা এক রিটের বিপরীতে ‘ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান ফর কক্সবাজার টাউন অ্যান্ড সি আপ টু টেকনাফ’ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী জোয়ার ভাটার মধ্যবর্তী লাইন থেকে প্রথম ৩০০ মিটার ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’ উল্লেখ করে এ এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কউকের মাস্টারপ্ল্যান। এ প্ল্যান বাস্তবায়নে কউক সমুদ্র সৈকতের ৩০০ মিটারে কোন স্থাপনা নির্মাণ থেকে বিরত থাকতে প্রচার চালানো হয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘রহস্যজনক কারণে উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক। যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে ইসিএ এলাকায় সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করা না হয় পরিবেশগত বড় হুমকিতে পড়বে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। তাই এখনি সময় দখলদাররা যতই প্রভাবশালী হোক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন হিমছড়ি টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘রাতের আধারে ঝাউবিথী কেটেছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। কিন্তু গভীর রাতে কাটায় আমরা তাদের ধরতে পারছি না। তবে মারমেইড কর্তৃপক্ষ সেখানে অবকাটামো তৈরি করেছে, সেবিষয়ে উপজেলা প্রশাসন দেখবেন। এটি আমাদের দায়িত্ব না।
এ ব্যাপারে মারমেইড বিচ রিসোর্টের মালিক আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগের মুঠোফােনে একাধিকবার চেষ্টা করলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তার জবাব দেননি তিনি।”
এদিকে মুঠোফােনে যোগাযোগ করা হলে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন ‘মারমেইড বিচ রিসোর্টের জেনারেল ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম সুজন।
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, ‘সরকারি জমি হোক আর ব্যক্তিগত জমি হোক, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ নেই। খাস বা সৈকতের বালিয়াড়ির জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে।”
এ বিষয়ে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) চেয়ারম্যান কমডোর (অব.) মোহাম্মদ নুরুল আবছারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।”