সুন্দরবনের পর কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতু্বদিয়া, পেকুয়া, বাশখালীকে দস্যুমুক্ত করতে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। দুই দফায় দুই দফায় র্যাব-পুলিশ ১৪২ জন জলদস্যু, ডাকাত, অস্ত্র কারিগরকে আত্মসমর্পণে রাজি করাতে পারেন।
পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়নও করা হয়। শান্তি ফেরানোর বার্তায় আত্মসমর্পন হলেও এখনো বন্ধ হয়নি জেলেদের উপর নির্যাতন। বিচ্ছিন্নভাবে থেমে থেমে বঙ্গোসাগরে মাছ আহরণে যাওয়া জেলেদের টার্গেট করে নির্যাতন-লুটপাট চালাতে থাকে একাধিক জলদস্যু বাহিনীর সদস্যরা।
গেল বছরের ২২ এপ্রিল কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক সমুদ্র উপকূলে টেনে আনা ডুবন্ত একটি ট্রলার থেকে ১০ জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছেন পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। যা দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করে। লাশ থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ ধারণা করেছিল, কমপক্ষে ১৫ দিন আগে গভীর সমুদ্রে জলদস্যুরা ট্রলারটির মাছ-জাল লুট করে জেলেদের হাত-পা বেঁধে কুটিরে (ট্রলারে মাছ ও বরফ সংরক্ষণের কক্ষ) আটকে রেখে ট্রলারটি সাগরে ডুবিয়ে দিতে পারে।
এসব ঘটনায় ঘুরে-ফিরে নাম আসে মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া দ্বীপের মনজুর ডাকাত ও তার সহযোগী জুনু ডাকাত, কুতুবদিয়ার গুরা কালো ডাকাত ও পেকুয়ার রাজাখালীর নুরুল আবছার ওরফে বদু ডাকাতের নাম। কিন্তু তৎকালীন সরকারী দল আওয়ামীলীগ নেতাদের বলয়ে থাকায় ধরাছোয়ার বাইরে থেকে যায়। এদের মধ্যে গুরা কালু ডাকাত অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পন করে। কিন্তু এরপর আরও তিনবার র্যাব-পুলিশের হাতে ডাকাতির অভিযোগে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন।
বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া উপকূলে একটি ট্রলারের মাঝিকে গুলি করে হত্যার পাশাপাশি ১৯ জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে জলদস্যুরা। নিহত মাঝির (সারেং) নাম মোহাম্মদ মোকাররম (৪৫)। ভোর চারটায় ‘এফবি আল্লাহর দয়া’-৩ নামের ট্রলারে এই হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় জেলেদের ধরা কয়েক লাখ টাকার ইলিশ মাছ, জাল ও ট্রলার লুট করে নিয়ে যায় জলদস্যুরা।
জেলেরা বলছেন, ‘সোনাদিয়া দ্বীপের ১০-১১ কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে ওই ট্রলারটি জলদস্যুর কবলে পড়ে। নিহত মোকাররমের বাড়ি কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের আজিম উদ্দিন সিকদার পাড়ায়। তিনি উত্তর ধুরুং ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য রহিমা বেগমের স্বামী।
ইউপি সদস্য রহিমা বেগম বলেন, ‘সকালে স্বামী মোকারমের মৃত্যুর কথা জানতে পারেন তিনি। সকাল পৌনে ১০টার দিকে পুলিশ চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে তাঁর স্বামীর লাশ উদ্ধার করেছে। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। তিনি এই ঘটনার বিচার দাবি করেন।
রহিমা বেগম আরও বলেন, ২১ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষ হলে গত সোমবার সন্ধ্যায় বাঁশখালীর শেখেরখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইসমাইলের মালিকানাধীন এফবি আল্লাহ দয়া নামের ট্রলার নিয়ে ২০ জন জেলে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ মাছ ধরতে যান। ওই ট্রলারের মাঝি ছিলেন মোহাম্মদ মোকাররম। গত বুধবার দুপুরে গভীর সাগর থেকে মাছ ধরে ট্রলারটি কক্সবাজারের ফিশারি ঘাটের দিকে ফিরছিল। আজ ভোরে এটি মহেশখালীর সোনাদিয়ার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছালে জলদস্যুদের কবলে পড়ে।
‘এফবি আল্লাহর দয়া’-৩ ফিশিং ট্রলারের মালিক বাঁশখালীর বাসিন্দা ইসমাইল বহদ্দার বলেন, ‘জলদস্যুদের গুলিতে মাঝি মোকাররম গুরুতর আহত হয়ে ট্রলার থেকে সাগরে ছিটকে পড়েন। এরপর জলদস্যুরা ১৯ জেলেসহ ট্রলারটি লুট করে নিয়ে যায়। অপর একটি মাছ ধরার ট্রলার সাগর থেকে মোকাররমকে উদ্ধার করে কুতুবদিয়ার মগনামা ঘাটে আনে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম নেওয়ার পথে বাঁশখালীতে তাঁর মৃত্যু হয়।
আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত ট্রলারসহ অপহৃত ১৯ জেলের সন্ধান মেলেনি বলে জোন ট্রলার মালিক মোহাম্মদ ইসমাইল। তিনি বলেন, সাগরে মহেশখালী-কুতুবদিয়া এলাকার একাধিক জলদস্যু বাহিনী তৎপর রয়েছে। মহেশখালীর জলদস্যু ‘মনজুর বাহিনী’ তাঁর আল্লাহর দয়া ট্রলারে গুলি ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত বলে খবর পেয়েছেন তিনি।
কক্সবাজার জেলা ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘১৯ জেলেসহ ট্রলারটি কোথায় আছে-তার অনুসন্ধান চলছে। কিন্তু রাত আটটা পর্যন্ত তাদের সন্ধ্যান মিলেনি।
এব্যাপারে জানতে চাইলে বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মহেশখালীর গভীর সাগরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত এক জেলের মরদেহ বাঁশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। পরে ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশটি পাঠানো হয়।
এতে বুঝা যাচ্ছে এঘটনার সঙ্গেও আলোচিত মনজুর ডাকাতের নাম উঠে এসেছে। পুলিশ ও স্থানীয় একাধিক দায়িত্বশীল সুত্র বলছে, ‘সোনাদিয়ার মনজুর ডাকাত এবার ডাকাতির ধরণ পাল্টে নিয়েছেন। তার নতুন জলদস্যু বাহিনীতে এবার তার পাশাপাশি নেতৃত্ব দিচ্ছেন আত্মস্বীকৃত গুরা কালো ডাকাত। দলে ভিড়িয়েছেন অর্ধ-শতাধিকের বেশি ডাকাত সদস্য। যাদের মধ্যে অধিকাংশই আত্মসমর্পণ করেছিলেন পুলিশের মধ্যস্থতায় অস্ত্র জমা দিয়ে।
একটি দায়িত্বশীল সুত্র থেকে পাওয়া ভিডিও চিত্র হাতে এসেছে এ প্রতিবেদকের। যেখানে দেখা যায়, ‘অন্তত ৫০ জনের একটি দল অস্ত্র হাতে কোহেলিয়া নদীর বদরখালী পয়েন্ট দিয়ে কোলে উঠে আসছেন। সুত্রটির দাবি, ‘দলটিই ডাকাতি করেছে ‘এফবি আল্লাহর দয়া’-৩ ফিশিং ট্রলারে। এসব সদস্যের হাতে দেখা যায় দেশীয় তৈরী একাধিক অস্ত্র।
তথ্যমতে, ‘২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর মহেশখালী-কুতুবদিয়া উপকূলের ৬টি বাহিনীর ৪৩ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেন। তাঁরা জমা দিয়েছেন ৯৪টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৭ হাজার ৬৩৭টি গোলা।
এই আত্মসমর্পণের সবচেয়ে আলোচনায় ছিলেন কুতুবদিয়ার রমিজ উদ্দিনের ‘রমিজ বাহিনী’। ৯৪ মামলার আসামী রমিজ আত্মসমর্পণের সুযোগে নিজেকে আলোরপথে ফিরিয়ে এনেছেন। বিচারিক মাধ্যমে কমেছে মামলার সংখ্যাও।
সোনাদিয়া চ্যানেলের ডাকাতির ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে আলোর পথে ফিরে আসা রমিজ বাহিনীর প্রধান রমিজ উদ্দিন বলেন, ‘অনেকে আলো পথে ফেরার কথা আত্মসমর্পণ করলেও নতুন করে একই পেশায় ফিরছেন। সাগরে জেলেদের আবারো নির্যাতন লুট করছেন। এটা আমাদের কখনো শান্তির বার্তা বইয়ে আনবে না।
এবিষয়ে কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্ণেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘জলদস্যুকে গুলি করে হত্যার বিষয়টি জানতে পেরেছি। ইতিমধ্যে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্বি করেছে। যেকোন মুহুর্তে অভিযান পরিচালনা করা হবে বরে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা। “