মায়ানমারের রাখাইনে চলমান সংঘাতের প্রভাব থাকলেও রাজ্যটির টাউনশিপ মংডু শহর আরাকান আর্মির দখলের পর অচল হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্ত বাণিজ্যে স্থলবন্দরের কার্যক্রম। দেশটি থেকে বন্দরের উদ্দেশ্যে আসা পণ্যবাহী জাহাজ-ট্রলার আটকে দিচ্ছে বিদ্রোহীরা। ‘আরাকান আর্মির’ প্রতিবন্ধকতায় স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম প্রায় বন্ধ দাবি সংশ্লিষ্টদের।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে- দীর্ঘ দেড় মাস পর গেল বৃহস্পতিবার মায়ানমারের ইয়াঙ্গুন থেকে স্থলবন্দরে আসার পথে নাফনদর খায়ুংখালী খালে পণ্যবাহী তিনটি কার্গো বোট আটকে রাখে আরাকান আর্মি। এসব বোটে ৫০ হাজার বস্তা পণ্যে রয়েছে। চারদিন পর ২০ জানুয়ারি সকালে আটকে রাখা দুইটি বোট ছেড়ে দেয়। যা পরবর্তীতে বেলা ১১ টার দিকে টেকনাফ স্থলবন্দরে এসে পৌছাই। আরাকান আর্মির এ ধরণের কর্মকান্ডে ব্যবসায়ীদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে।
এ বিষয়ে টেকনাফের স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোট লিমিটেড মহাব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এ ঘটনার পর থেকে ব্যবসায়ীরা আতঙ্কের মধ্য রয়েছে। কেননা এর আগে থেকে সেদেশের সংঘাতের কারনে ব্যবসায়ীরাদের পণ্য আসা কমেছিল। তবে এই সমস্য সমাধানে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত। অন্যতায় টেকনাফ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে ব্যবসায়ীরা।
টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর বলেন, ‘পণ্যবাহী কার্গোগুলোর মধ্যে দুইটি ছেড়ে দিয়েছে। এখনো আরও একটি কার্গো ছাড়েনি আরাকান আর্মির। এখানে প্রায় ৩০-৪০ কোটি টাকার মালামাল রয়েছে। যেখান থেকে বিপুল পরিমান টাকা সরকারও রাজস্ব পাবে।’
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সংঘাতের পর থেকে সীমান্ত বাণিজ্যর ব্যবসায়ীরা খুব বিপদে রয়েছে। অনেকে পণ্যের জন্য ডলার পাঠানোর পর যুদ্ধের কারনে মালামাল আনতে পারছেনা। এতে ব্যবসায়ীদের খুব লোকসানে পরছে। যার কারনে অনেক ব্যসায়ী টেকনাফ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছে। তাই সরকারের উচিত মিয়ানমারের সাথে কথা দু’দেশের স্বার্থে সীমান্ত বাণিজ্য সচল রাখা।’
কেন আটক হল পণ্যবাহী কার্গো?
মিয়ানমারের সংঘাতে ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত আরাকান আর্মি দখলের নেওয়ার পর থেকে ভয়ভীতিতে ছিল সীমান্তের বাণিজ্যের ব্যবসায়ীরা। আরাকান আর্মি নিজেদের রাষ্ট্র ঘোষনা করে তারাও বাণিজ্য ভাড় বসানোর চেষ্টায় ছিল তখন থেকে। তারই অংশ হিসেবে (১৬ জানুয়ারী) গত বৃহস্পতিবার টেকনাফ স্থল বন্দরে আসার পথে পণ্যবাহী কার্গোগুলো আটক করেছে বলে জানিয়েছেন স্থলবন্দরের এক ব্যবসায়ী।
তিনি বলেন, ‘পণ্যবাহী কার্গোগুলো আটকের পর থেকে আমাদের সেদেশের ব্যবসায়ীরা তাদের (আরাকান আর্মির) সাথে যোগাযোগ করে আসছে। শুরুতে পণ্যবাহী ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে আসলেও এখন তারা (আরাকান আর্মি) এই পণ্য থেকে লেনদেনের ভাগ চাই। না হলে কেন পণ্যবাহী কার্গোগুলো আটক করছে। তবে তারা সেটি এখনো পরিস্কার করে কিছু বলছে না।’
সীমান্ত বাণিজ্যে হস্তেক্ষেপ আরাকান আর্মি
যেহেতু তাদের জলসীমানা হয়ে বাংলাদেশে পণ্যবাহী ট্রলার আসতে সেই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে আরাকান আর্মি বললেন কক্সবাজার চেম্বার অব কর্মাসের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘বলতে আরাকান আর্মি এখন সীমান্তে বাণিজ্যর মধ্য ভাগ বসাতে চায়। তারঁ কারনে পণ্যবাহী ট্রলারগুলা আটক রেখেছে। কমিশন (টাকা) পেলে ছেড়ে দেবে। কারন এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। কেননা ইতি মধ্য তাদের (আরাকান) পারমিট নিয়ে ট্রলার আসতেছে। তাই দুই দেশের স্বার্থে সেখানকার ব্যবসায়ীদের উচিত তাদের সাথে বসে এটার স্থায়ী সমাধান করা। অন্যতায় সীমান্তে বাণিজ্য ব্যাপক প্রভাব পরবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পণ্যবাহী ট্রলার আসতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পর থেকে তাদের জলসীমানায় পার হতে হয়। যেটি বর্তমানে আরাকান আর্মির দখলে। তাই তারা পণ্যবাহী কার্গো বোটগুলো আটকানোর সুযোগ পেয়েছে। আরাকান আর্মি তাদের জলসীমানা থেকে পারমিট না দিলে পণ্যবাহি কোন ট্রলার এখানে (স্থলবন্দরে) আসা সুযোগ নেই। সেটিকে কাজে লাগিয়ে তারা সীমান্ত বাণিজ্যর ভাগ বসানোর চেষ্টা করছে।
স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী শওকত আলম বলেন, ‘বন্দরে পণ্যবাহী কার্গো পৌছেনি। এখনো তাদের হেফাজতে রয়েছে। আমাদের ব্যবসায়ীরা চেষ্টা করছে, সমাধানের। এ ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মাঝে দু:চিন্তা নেমে এসেছে। সরকারেরও উচিত এটি সমাধানের এগিয়ে আসা।’
সরেজমিনে টেকনাফ সদরের কেরুনতলী এলাকায় স্থলবন্দরে কোন মানুষ জনের দেখা মেলেনি। জেটিঘাটগুলো ফাকা দেখা গেছে। তবে কাঠের পয়েন্টে মিয়ানমার থেকে আসা ছোট একটি কাঠের ট্রলার খালাস করছে শ্রমিকরা।
কাঠের ট্রলার নিয়ে আসা আবু সুফিয়ান মাঝি বলেন, ‘কাঠের ট্রলার নিয়ে কাল (শনিবার) স্থল বন্দরে পৌছেছি। আসার পথে নাফনদের সেদেশের জলসীমানায় মংডু কায়ুংখালী খালের পাশে তিনটি পণ্যবাহী কার্গো বোট হেফাজতে দেখেছি। কিন্তু আমাদের ট্রলারে থামাতে বলেনি। কারন তাদের সাথে মালিকের বুঝাপড়া রয়েছে।’
স্থলবন্দরের মাঝি মো. শামসু বলেন, ‘স্থলবন্দরে কোন কাজ নেই। পুরো জায়গা খালি পরে আছে। শ্রমিকদের বেকার সময় যাচ্ছে। অনেক দিন তিনটি কার্গো বোট আসার কথা ছিল। সেগুলোও আটক করেছে আরাকান আর্মি। তাছাড়া গতকাল ছোট একটি কাঠের ট্রলার এসেছিল বন্দরে। সেটি খালাস চলছে।
এদিকে মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধে গত ৮ ডিসেম্বর রাখাইন রাজ্যে মংডু টাউনশিপ আরাকান আর্মির দখলে নেয়। এরপর থেকে কোনো পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরে আসেনি। সর্বশেষ মিয়ানমার থেকে ৩ ডিসেম্বর টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ এসেছিল।
স্থলবন্দর একাধিক ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ‘দীর্ঘ দেড় মাস পর মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন থেকে গত শনিবার সেদেশের ব্যবসায়ী তারুয়া মিতা, সৌ টাংসহ কয়েকজ ব্যবসায়ীর পণ্যবাহী কার্গো বোট টেকনাফ স্থলবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেয়। পাচঁদিনের মাথায় কার্গোগুলো গত বৃহস্পতিবার বেলা ১২ টায় নাফনদের মোহনায় সেদেশের জলসীমানায় নাক্ষ্যংকদিয়া নামক এলাকায় তল্লাশির নামে কার্গো তিনটি আটকে দেয় আরাকান আর্মি। সেখানে ৫০ হাজারের বেশি বস্তা মালামাল রয়েছে। এর মধ্য আচার, শুঁটকি, সুপারী, কপিসহ বিভিন্ন মালামাল রয়েছে। এসব পণ্য স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী শওকত আলী, ওফর ফারুক, মো.আয়াছ, এম এ হাসেম, মো. ওমর ওয়াহিদ, আবদুর শুক্কুর সাদ্দামসহ সহ অনেকের মালামাল রয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ২ বিজিবি অধিনায়ক লেঃ কর্নেল আশিকুর রহমান বলেছিলেন, ‘টেকনাফ স্থলবন্দরে আসার পথে মিয়ানমার জলসীমানায় পণ্যেবাহি কার্গো বোটে তল্লাশি চালানো হচ্ছে বলে শুনেছি। তবে এটি আমাদের জলসীমানার বাইরে।
১৭০ কোটি রাজস্ব বঞ্চিত সরকার
এ বিষয়ে টেকনাফ স্থলবন্দর শুল্ক কর্মকর্তা এম আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলেন, গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের ২৩ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৭ হাজার মেট্রিক টন পণ্যে আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে সরকার ২৫৭ কোটি টাকা রাজস্ব পায়। গেল বছর (২০২৪-২৫) অর্থ বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ হাজার মেট্রিক টন আমদানি হয়। যার ফলে সরকার ৮৭ কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার।
রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধের প্রভাবে গত বছরের তুলনায় ১৭০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় কম হয়েছে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে গত দুই অর্থ বছরে যেসব পণ্যে রপ্তানি হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমান সিমেন্ট বলে তথ্য দিয়ে শুল্ক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসুম জানান, গত ২৩-২৪ অর্থ বছরের সিমেন্ট রপ্তানি হয়েছে ২৩৬ মেট্রিক টন। যার মূল্য ১ কোটি ১৩ লাখের অধিক টাকা মূল্যের সিমেন্ট। এছাড়া চলতি ২৪-২৫ অর্থ বছরে ২৯১ মেট্রিন টন সিমেন্ট রপ্তানি হয়েছে। যার মূল্য ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। মিয়ানমারে মংডু শহর আরকান আর্মি দখলে নেওয়ার পর আমাদের দেশে পণ্যবাহী জাহাজ গুলো আসে।